বাংলাদেশের শোবিজে নন্দিত এক নাম বিপাশা হায়াত। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেত্রী। একজন গুনী নাট্যকারও। ছবিও আঁকেন নিয়মিতই। তবে টেলিভিশন, মঞ্চ, চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্যই বিখ্যাত তিনি।
আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এবারে ৫১ বছরে পা রাখলেন অভিনেত্রী। প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াতের বড় কন্যা তিনি। কালের প্রবাহে তিনিও হয়ে উঠেছেন জাত শিল্পী। আশির দশকে ‘খোলা দুয়ার’ নাটকে বাবার মেয়ে হয়েই অভিনয় শুরু করেন। এরপর যুক্ত হন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে। টিভি নাটকে প্রথমে আলোচনায় আসেন ‘অয়োময়’ ধারাবাহিক দিয়ে।
এই গুণী শিল্পীর জন্মদিনে আবেগঘন এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর লেখেন:
প্রিয় #বিপাশা,
আজ তোমার ৫১.আহা! স্বাধীনতার ৫১ বছর,তোমারও ৫১বছর..
আজ তুমি আমাদের থেকে দূরে।
সেই দূরত্ব মনের না। পথের। এতদূর থেকেও তোমার মুখটা ভেসে উঠল। কত কত স্মৃতি তোমার সাথে আমার।
ভালো থেকো তুমি। সাবধানে থেকো।
তোমার জন্মের গল্পটা আমি প্রতিবার লিখি, এই প্রজন্মের জন্য। কেউ মিস করলে বার বার পড়বে তাই।
আন্টিকে ধন্যবাদ তোমাকে জন্ম দেবার জন্য।
তুমি সত্যি অনেক গুণী একজন শিল্পী। গুনী মা বাবার সুযোগ্য সন্তান তুমি। প্রাউড অফ ইউ।
শুভ জন্মদিন।
তোমার চয়ন আপা।
প্রতিবারের মত এইবারও চয়নিকা চৌধুরী তাঁর গল্পটা ফেসবুকে সবার জন্য শেয়ার করেছেন । গল্পটা হলো-
সহজ কথা যায় না বলা সহজে। সত্যিই তাই। আজকের দিনটা খুব সুন্দর। সকালের সূর্যটাও। কিন্ত ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের এই দিনটা এমন ছিল না।
১৯৭১ সালের ২২ মার্চ শিরিন হায়াতের কোলে সেন্স হারালেন অসুস্থ আবুল হায়াত। তার নাক দিয়ে তখন রক্ত ঝড়ছে। শরীর থেকে রক্ত চলে যাচ্ছে।
এদিকে শিরিন হায়াত মা হতে চলেছেন। ডাক্তার বলেছিলেন, এপ্রিল মাসে তিনি মা হবেন।
কিন্ত স্বামীর এই অবস্থায় তখনই তার প্রসব ব্যাথা ওঠে। দেশের অবস্থা তখন ভয়াবহ। বাঙালী চারিদিকে পাকিস্তানী পতাকা পোড়াচ্ছে। থমথমে অবস্থা। শিরিন হায়াত স্বামীকে ওইভাবে রেখে চলে গেলেন হলিফ্যমিলি হাসপাতালে। সন্তানকে তো জন্ম দিতে হবে।
২৩ মার্চ ভোর সকালে জন্ম হলো ফুটফুটে একটি কন্যা। যেন সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতে বানিয়েছেন। যদিও এক মাস আগে হওয়াতে কন্যা আন্ডার ওয়েট।
কন্যার মায়ের খুব অভিমান, কারণ তিনি ভাবছেন মেয়ে হয়েছে বলে হয়তো তার শ্বাশুড়ী তাকে আর তার কন্যাকে দেখতে আসেননি। কিন্তু গল্প অন্য।
আবুল হায়াত তখন ডা: রাব্বীর আন্ডারে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। টানা পাঁচ দিন তার সেন্স ছিল না। শরীরে কোন রক্ত নেই। অচেতন তিনি। সবাই তখন আবুল হায়াতকে নিয়ে ব্যস্ত।
২৫ মার্চ আরো ভয়ংকর চারিদিক। হাসপাতালে সব বিদেশী নার্স ডাক্তার। হাসপাতালের বাইরে তোলপাড়। মেশিনগান, কামান ঘিরে রেখেছে চারিদিক। বিকট আওয়াজে খাটের নিচে শিরিন হায়াত ছোট্ট শিশুকে বুকে তুলে প্রার্থনা করতেন, দেখা হবে তো তার স্বামীর সাথে!! স্বাধীন হবে তো প্রানের এই দেশ!!
২৭ মার্চ তারিখ শিরিন হায়াত সব জানতে পারেন। ওই দিন যে ছেলেটি সব তথ্য দিয়েছিল সে পাকবাহিনীর হাতে মারা যায়।
ডাঃ রাব্বীকেও পাকিস্তানীরা গুলি করে মারে।
২৮ মার্চ নৌকা করে দেশে নেয়া হয় আবুল হায়াত কে। ৫ দিন পর তিনি তার কন্যার মুখ দেখেন।
এই কন্যাটিই গুণী মানুষ আজকের বিপাশা হায়াত। মা বাবার যোগ্য সন্তান। যে মা নিজের জীবন বাজি রেখে স্বামীকে রেখে রিকশা করে হাসপাতালে গিয়েছিল সন্তান জন্ম দিতে।
বিপাশা হায়াত। সবাই তাকে আজ চেনে। চমৎকার একজন আবেগপ্রবণ মানুষ।
যে মানুষ একজন সত্যি কারের মানুষ হিসাবে স্বীকৃত। ভালো আঁকে, অভিনয় করে, খুব ভালো গান গায়। কোন প্যঁচ নাই। কারোর ধারে নাই পাছেও নাই। ভালো কে ভালো বলতে কোন দ্বিধা করেনা।
মায়ের মত দারুণ রান্না করে। স্বামী অন্ত প্রাণ। সংসার, ছেলে মেয়ে তার জীবনের প্রথম প্রায়োরিটি। তাদের ভালো মন্দে তার চোখ জলে ভরে যায়।
এই মানুষ টার সাথে আমার অনেক সুন্দর স্মৃতি। সুন্দর মুহূর্ত। তা আজ থাক।
শুধু এইটুকু বলি, বিপাশার জন্যই আজ আমি কিছু লেখার সাহস করতে পারি।
যদিও কিছুই হয়না। কিন্ত চেষ্টা করি। আমি কৃতজ্ঞ।
শুভ জন্মদিন বিপাশা।
আনন্দময় হোক জীবন। অনেক শুভ কামনা তোমার জন্য সবসময়। অভিনন্দন শিরিন হায়াতকে তোমাকে জন্ম দেবার জন্য। সবাই কে নিয়ে সুস্থ থেকো,ভালো থেকো। অনেকদিন বেঁচে থাকো এই সুন্দর পৃথিবীতে। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। কতটা তা তুমি নিজেও জানো না। আমিও না। তোমাকে বলার জন্য বা তোমাকে শোনানোর জন্য আমি এই লেখা লিখিনি।
আমার কৃতজ্ঞতার কথা সবার সাথে শেয়ার করতে আমার ভালো লাগে। কাজের জায়গায়, জীবন বোধের ছোট ছোট জায়গায় তোমার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সেই দিন গুলি আমার জীবনের গোল্ডেন মোমেন্ট।
তোমার চয়ন আপা সত্যিই ঋণী। “সদা থাকো আনন্দে। সংসারে নির্ভয়ে…..”
আবারও শুভ জন্মদিন বিপাশা।
ভালোবাসা আজ তোমার জন্য।
নির্মাতা ( চলচ্চিত্র এবং নাটক)
চয়নিকা চৌধুরী।